চিরকুট প্রেম l খোরশেদ আলম l
চিরকুট প্রেম
খোরশেদ আলম
বালিশ কান্ডে লন্ডভন্ড কয়েকটা জীবন। মনে পড়ে যায় সে দিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার কথা। এক বন্ধু এসে হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বললো, তার বোন এটা পাঠিয়েছে আমাকে দেবার জন্য। সাথে আশেপাশে বসা বাকি বন্ধুরাতো খুবই উত্তেজিত।
-আচ্ছা দেখ না কী? একজন বললো।
আমি বললাম, গুরুত্বপূর্ণ কিছু হবার সম্ভাবনা
নাই।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। ঐ চিরকুট নিয়ে রীতিমত টানাটানি
শুরু হয়ে গেল সবার মধ্যে, কী আছে? এই টানাটানির মধ্যেই ওটা মোটামুটি কয়েক টুকরায় বিভক্ত। যাই
হোক মনে মনে ভাবলাম কী ছিলো দেখিতো যে টুকরো আমার কাছে আছে। তাকিয়ে দেখি কচি কাঁচা
হাতের নেখা ক’টা অক্ষরে লেখা,
-মা আপনাকে আসতে বলছে!
আর কোন লেখার মাথামন্ডু বোঝা গেলো না, এখন অন্যদের হাতে যে কয়েকটুকরো পড়েছে, সে অংশগুলো পড়ে তারা নিজেরা হাসতে হাসতে খুন। আমার লজ্জা
লাগতে লাগলো এ জন্য যে, কী থাকতে পারে ওতে যা দেখে ওরা এত হাসছে। মেয়েটার ভাইও
আমাদের বন্ধু, এখন ও কী মনে করবে যদি এমন হাসির কিছু
তার বোন তাকে দিয়ে পাঠায়! বন্ধুর বোনটি পরিবারের
অনেক আদরের আর চোখের মণি সবার। আমরাও স্নেহ করি। কিছুদিন পরেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে
বসতে হবে জানি। ভালো ঘরে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে বিদেশে থাকে। টাকা পয়সার অভাব
নাই। এসব কিছু আমরা সবাই জানি, কিন্তু এখন কেমন
যেন ভয় ভয় লাগছে যে, আমি মনে হয় কোনো
অপরাধ করে ফেলেছি।
বন্ধুদের অনেক অনুনয় বিনয় করে টুকরো কাগজগুলো আমার হাতে
নিলাম। কিন্তু খুলে দেখার আর সাহস হলো না। সব ক’টা টুকরো কুচিকুচি করে ঝুড়িতে ফেলে দিলাম। এর মধ্যে একজন লাফিয়ে গিয়ে এক চিমটি
তুলে এনে দেখে তাকে লেখা, বালিশ। আর যায় কই ? যে যে টুকরা
পড়েছে সে, সে টুকরোর হাইলাইট শোনানো শুরু করলো। সারমর্ম
এই, মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে এই মর্মে সে এই চিরকুটটি তার আপন ভাইয়ের হাতে আমার
কাছে পাঠিয়েছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এমন কোন কিছু হতে পারে। কিন্তু মনটা
যেনো কেমন হয়ে গেলো, ভয় আর লজ্জা মেশানো কেমন এক
রোমাঞ্চকর অনুভূতি।
কাউকে কিছু না বলেই বাড়ীর উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা হলাম। সন্ধ্যে হলে ঘরে ফেরাই নিয়ম ছিলো, আজান দেওয়া মাত্র দৌড়ে বাড়ী পৌঁছে হাতমুখ ধুয়ে পড়ার
টেবিলে বসা ছিলো বাধ্যতামুলক। বাড়ী ফিরে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসি। পড়ায় কী আর মন বসে?
ভাবছি, কী ছিলো ঐ চিরকুটটায়। কেন বলেছিলো তার মায়ের সাথে দেখা করতে? চাচী আমাকে অনেক
আদর স্নেহ করতেন। বসে বসে ভাবছি কিন্তু কোন কুলকিনারা পাচ্ছি না। কেন ডেকেছেন চাচী? কী হতে পারে? ছোট্ট মনে নানা
প্রশ্ন তখন কিন্তু কোন উত্তর নেই।
মাকে না বলেই সাহস করে গেলাম তাদের বাড়ীতে। চাচী দেখেই বলে
উঠলেন,
-কি রে কেমন আছিস, এত রাতে কেন?
রাত তখন ক’টা হবে?
বড়োজোর আটটা। বললাম,
-না তেমন কিছু না।
বন্ধুর নাম ধরে বললাম ও বাসায় আছে কী না। চাচী বললেন,
-সে তো নানা বাড়ী গেছে লোকজন দাওয়াত করতে।
শুনে মনে পড়লো ক’দিন পর তার
ছোটবোনের বিয়ে, মেয়েটা মাত্র তখন অষ্টম শ্রেণী শেষ
করে নবম শ্রেণীতে যাবে। চাচীর ডাকে চিন্তা থেকে বাস্তবে ফিরলাম। বললেন,
-যাও ঘরে গিয়ে বসো, তুমি আসছো, ভালো করেছো, রাতে খেয়ে যাবে, তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার।
আমি ঘরের ভিতর ঢুকে সামনে চৌকির উপর বসলাম। দেখলাম মেয়েটা
ভিতরের রুমের পড়ার টেবিল থেকে তাকিয়ে আছে। আমার কেমন যেনো লাগছিলো তখন, মনে হচ্ছিলো আমি কখনো এত সুন্দর মেয়ে দেখিনি, আর ও যে এত সুন্দর কখনো কেন তা খেয়াল করিনি? টেবিল ছেড়ে আলতো পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো সে।
তারপর খুব ছোট করে বললো,
-কেমন আছেন?
আমি কিছু বললাম না, শুধু তাকিয়ে
আছি তার দিকে। মনে মনে ভাবছি এ বয়সে এই মেয়েটার বিয়েটা না দিলেই কি হতো না? আবারো যখন সে জিজ্ঞেস করলো “কেমন আছেন” সম্বিত ফিরে পেলাম, বললাম, ভালো আছি, সামনে পরীক্ষা
একটু লেখা পড়ার চাপ যাচ্ছে। তা তুমি কেমন আছো? দেখলাম লেখাপড়া করছিলে মনে হয়?”
সে বললো,
-আর লেখা পড়া, নিশ্চয়ই শুনেছেন
আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? ছেলে বিদেশে থাকে।
আমি কিছু বলছি না দেখে, প্রায় ধমকের সুরে বললো
-চুপ করে আছেন কেন? কথা বলছেন না
কেন?
চাচী কখন এসে দাড়িয়েছে ওর পিছনে আমি বা ও কেউ খেয়াল করিনি।
উনি বলে উঠলেন,
-তুই ওর সাথে উঁচু গলায় কথা বলছিস কেন? ওকে কিছু খেতে দিছিস? রান্না হতে আরো একটু সময় লাগবে, লাকড়ির চুলার আগুন ঠিক মত জ্বলছে না। ভিজে লাকড়ি। গাছের
কলা আছে, যা ওকে দুইটা দে, সাথে মুড়ি দে। চাচী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-বাবা তুমি খাও আমি গেলাম।
পিছন ফিরে মেয়েকে বললেন,
-বড়দের সাথে সুন্দর করে কথা বলতে হয়। বহুবার বলেছি না? ক’দিন পর থেকেই পস্তাবি।
মেয়েটি মুখ ঝামটা মেরে বলে উঠে,
-কে বড় উনি? উনি কিছু বেঝে? কিচ্ছু বেঝে না। উনি যদি বড় হত তাহলে বুঝতো সব।
বলেই সামনে থেকে হনহন করে সে হেঁটে ঘরের ভিতরে চলে গেলো। চাচী
একটু অপ্রস্তুত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন, বললেন
-বাবা তুমি কিছু মনে করো না, ওর বাবা বেশি আদর দিয়ে মাথায় তুলে রেখেছে, ভাইটাও তেমনি কিচ্ছু বলবে না, যেন তার বোনের
কোন দোষ থাকতেই পারে না। আচ্ছা তুমি বোস ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আর আজ না খেয়ে যাবে না। আমি শুধু হতবিহ্বল হয়ে
বসে আছি আর চিন্তা করছি। এমন পরিস্থিতিতে কী বলতে হয় জানা নেই। যে চিরকুটের টানে
এই রাতের বেলায় এখানে এলাম সে বিষয়ে এখনো কোন টুশব্দটিও করিনি বা সেও কিছু বলেনি।
মনের মাঝে একটু একটু বিন্দু বিন্দু ভালো লাগা জমে উঠছে। কিসের একটা ভয় মিশ্রিত
শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শিরদাঁড়ায়। ভালো লাগার সাথে প্রচন্ড একটা ভয় কাজ করছে মনের
ভিতর। রীতিমত ঘেমে উঠেছি, শীত কাল ঘামার কোন কারণ
নেই তবুও কপাল ঘেমে উঠেছে বেশ বুঝতে পারছি।
এত সুন্দর কোমল স্নিগ্ধ একটা মেয়েকে এত তাড়াতাড়ি তার বাবা
মা কী করে বিয়ে দিয়ে বিদেয় করবেন! একটা বেশ
অস্বস্তি অনুভব করা শুরু করলাম বিয়ের কথা মনে পড়তেই। কাউকে কিছু না বলে উঠে
দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ঘরথেকে বের হয়ে গেলাম। তাদের ঘরের সামনের পুকুরপাড় ধরে সামনে
এগিয়ে গ্রামের ঘুটঘুটে অন্ধকার মেঠো পথ ধরে বাড়ীর উদ্দ্যেশ্যে হাঁটতে লাগলাম। ওই
শীতের মধ্যেও হাল্কা হিমহিম বাতাসটা যখন মুখে লাগছিলো, অনেক ভালো লাগছিলো। আর বুকের ভিতরের চিনচিন ব্যথাটা টের
পাচ্ছি পরিস্কার। কী ছিলো পুরো চিরকুট জুড়ে। চাচীর ডাকের পাশাপাশি একটা শব্দ মনে আছে বালিশ। কী ছিলো
পুরো চিরকুট জুড়ে?
আমি বাড়ী পৌঁছাতে গিয়ে আনমনে নদীর ধারে চলে গিয়েছি, সেখানে ঘাটে নৌকা পারাপারের ব্যবস্থা ছিলো, ছিলো ফরিদের চায়ের দোকান। ফরিদের বাবা বলে উঠলেন,
-এই তুই এত রাতে এদিকে কী করিস। তুই না এবার মেট্রিক দিবি? যা বাড়ী গিয়ে পড়ালেখা কর, সারা বেলায় শুধু খেলা আর আড্ডাবাজি করলে আমার মত চা বিক্রি করা লাগবে। যা
বাড়ি যা, কিছু খাবি?
বললাম, ভালো লাগছিলো না তাই হাঁটতে বের
হয়েছি। তারপরে কাকাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-কাকা, ফরিদ কোথায়?
-ওতো সারাদিন গতর খেটেছে ক্ষেতে সবজি করবে। বাড়িতে
গিয়ে শুয়ে পড়েছে মনে হয়। তোদের সাথে চেস্টা করেও তো স্কুলে পাঠাতে পারলাম না।
কাকা আর কী কী বললেন সেদিকে মন না দিয়ে উল্টোঘুরে বাড়ীর
পথে রওয়ানা দিলাম। বাড়ী এসে দেখি মা দাদীরা মিলে আমায় খুঁজছেন, না বলে কোথায় গেলাম এই শীতের মধ্যে। আমাকে দেখতে পেয়ে মা
হাতধরে টেনে নিয়ে গেলেন ঘরের ভেতর। দাদীকে খুব ভয় পেতেন মা। দাদী যেনো আমাকে বকা
না দিতে পারেন সে জন্যই মা অমন করে টেনে নিয়ে গেলেন। ঘরে ঢুকে মাথায় হাত বুলিয়ে
জানতে চাইলেন কোথায় গিয়েছিলাম রাতের বেলা। সত্যি কথাই বলেছি যে অমুক বাড়ী গিয়েছি, চাচী খেয়ে আসতে বললেন কিন্তু আমি না খেয়ে চলে এসেছি। আমাকে
খেতে দেন।
মা খাবার রেডি করতে করতে বললেন
-শুনলাম ওই মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছে, ছেলে না কি বিদেশে থাকে?
আমি উত্তরে শুধু ‘হু’ বললাম। মা আরো যোগ করলেন,
-মেয়েটা বেশ লক্ষ্মী, আরো পরে বিয়ে দিলে ভালো হতো, দেখিস তোর নিজের বোনটারে তোর বাবা কত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে
দিলো। এখন ওর কতকষ্ট হয় একটা সংসার সামলাতে। হিমশিম খায় মেয়েটা, অসুস্থ হয়ে গেছে। তোর নানা গরীব ছিলেন বলে আমাকেও চৌদ্দ বছর
বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। এখন অসুখ বিসুখ লেগেই আছে। এই বলেই মা বললেন বস্, খা। পিঁড়িতে বসে হাত ধুয়ে খেতে খেতে মা কে বললাম,
-মা মেয়েদের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয় কেন?
মা কী মনে করলেন জানি না। আমার মুখের দিকে চেয়ে কিছু বুঝলেন কী
না তাও বলতে পারবো না। শুধু বললেন
-বাবা, মেয়েদের অনেক যত্ন নিতে হয়। আর বাবা মা মেয়েদের বিয়ে
না দেয়া পর্যন্ত শান্তি পায় না।
আমি আনমনে খাওয়া শেষ করে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম।
আমি ঐ মেয়েটার বাড়ীর সামনে দিয়ে খেলতে যেতাম মাঠে। সেদিন
থেকে খেয়াল করলাম সে সাথে বাড়ীর অন্যদের সাথে নিয়ম করেই দাঁড়িয়ে থাকতো। অন্যদের
সাথে খেলার ছলে তাকিয়ে থাকতো। আগেও হয়তো থাকতো দাঁড়িয়ে খেয়াল করিনি কখনো। কিন্তু
সেদিনের পর থেকে ওদিক দিয়ে যেতে খেয়াল করতে লাগলাম। আর সাথের বন্ধু খুব মজা করতো
আমাকে নিয়ে। ওদের বাড়ীর সামনে থেকে ওর ভাইও আমাদের সাথে যোগ দিত দলে। সে রাতের পর
আর ওদের বাড়ী যাওয়া হয়নি তার গায়ে হলুদের রাত পর্যন্ত। সেই রাতের কথা মনে পড়লে
আজও বুকের গভীরের সেই চিনচিনে ব্যথাটা অনুভব করি। শেষ তার সাথে যেদিন দেখা হলো কথা
হলো সেদিন তার নতুন ভুবনে যাওয়ার প্রতস্তুতি চলছিলো জোরেসোরে। বন্ধুর বোনের গায়ে
হলুদ। কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে তাই আমরা অনেকেই প্রায় পুরোটা দিন তাদের
বাড়ীতেই কাটালাম। মাঝে মাঝে মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়েছে। বারবার মনে হয়েছে কিছু
বলতে চায়। আমি সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছি। মনে অনেক উথালপাতাল সত্বেও তার কাছে যাইনি
সারাদিন। সন্ধ্যার পর যখন নিজ বাড়ীর আসে পাশের বাড়ীর এবং আত্মীয়স্বজনরা এসে
হাজির হচ্ছে। সবার মধ্যে দারুন একটা আনন্দ উৎসবের আমেজ। ততক্ষণে বুকের রক্ত ক্ষরণ
টেরপেতে শুরু করেছি। ওদের ঘরের সামনের চৌকিতে বসে আছি ওর ভাইয়ের সাথে এমন সময়
মেয়েটা হুট করে এসে হাজির। এসেই বললো তার ভাইকে,
-ভাইয়া, তুই একটু দরজায় দাঁড়া। ওনার সাথে আমার একটু জরুরী কথা আছে।
বন্ধুটি বিনাবাক্যব্যয়ে উঠতে যাচ্ছিল আমি তার হাত ধরে
বললাম,
-বস্ তুইও শোন ও কী বলে।
কিন্তু বন্ধু বললো, এক মিনিট আমি আসছি” এই বলেই উঠে গিয়ে দরোজার
সামনে দাঁড়ালো।
মেয়েটি আমার পাশে এসে বসেছে। আমার বুকের ধড়ফড় শব্দ স্পষ্ঠ
আমি শুনতে পাচ্ছি, সমস্ত শরীর আমার অবস
লাগছিলো। কী বলবে মেয়েটা! ও জানতে চাইলো আমি সে
দিনের চিরকুট টা পড়েছি কী না? এবং ঐ রাতের পর
কেন আজকের আগে পর্যন্ত তাদের বাড়ী আসিনি। আমি শুধু বলেছি “হু”। আর কোন শব্দ আমার মুখ দিয়ে বের হয়নি। মেয়েটি আমার সামনে বসা, তার মুখের দিকে তাকাতেই আমার সারা পৃথিবী যেনো কেঁপে উঠলো।
অঝরে কাঁদছে সে। আমার নিজেকে প্রচন্ড বোকা বোকা লাগছিলো তখন। কোনমতে বললাম
-কাঁদছো কেন?
সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনার হাতটা একটু ধরি?
আমি ঝট করে একটু সরে গিয়ে বললাম,
-কেন? আজ তোমার গায়ে হলুদ হয়তো
সবাই খুঁজছে তোমায়।”
সে বললো,
-মা জানেন আমি এখানে, আর ভাইয়াও আছে
ডাকলে চলে যাবো। আপনার হাতটা একটু দিবেন? প্লিজ?
আমি খুব নার্ভাস হয়েও হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। সে দুহাতে আমার হাত দুটো
ধরে শুধু বললো,
-আমাকে মাফ করে দিয়েন, আপনি অনেক ভালো, আমি কিছু না বুঝেই হয়তো কষ্ট দিয়েছি আপনাকে। বলেন আপনি
আমাকে মাপ করে দিয়েছেন।
ততক্ষণে আমার চোখের পানি পড়া শুরু হয়েছে। একটা মেয়ে একটা
ছেলের হাত ধরে আছে আর দুজনেরই চোখে পানি। এখন যদি কেউ এসে দেখে কারো কোন মানসম্মান
থাকবে না। অথচ কালকে মেয়েটার বিয়ে। আমি একহাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম,
-তুমি কী করেছো যে মাপ চাইছো? বরং আমি যদি কোন ভুল করে থাকি
বা তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকি তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আর তুমি অনেক ভালো ও সুন্দর
একটা মেয়ে। তুমি সবসময় হাসি খুশি থেকো।
মেয়েটা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে আমার সামনে মুখামুখি দাঁড়ালো। একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে
নিয়ে হুট করে বসেই আমার পা ছুঁয়ে বলে উঠলো
-আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আর আমারে মাপ করে দেন।
কেমন একটা অস্বস্তি নিয়েও আমি তার মাথায় হাত রেখে
বলেছি “তুমি ভালো থেকো।”
ওখান থেকে মেয়েটা এক দৌড়ে চলে গেল। তার ভাইটা আমার পাশে
এসে বসতে বসতে বললো।
-তোকে একটা কথা বলি, সেদিন যে
চিরকুট টা তোকে ও পাঠিয়েছে আমাকে জিজ্ঞেস করেই পাঠিয়েছে। ও তোকে খুব পছন্দ করে। মাও
তোকে অনেক পছন্দ করে, আর তুই আমার বন্ধু, তোকে ওদের চেয়ে ভালো আমি চিনি। আমি নিশ্চয় আমার বোনের খারাপ চাই না। কিন্তু আমাদেরতো কারো
বিয়ে করার বয়স নয়। আমি ওকে অনেক বুঝিয়ে বলেছি, ও শুধু বলেছে যে, ও তোকে পছন্দ করে সে
কথাটা তোকে জানাতে চায়। তাই আমি না করিনি। আর আজ তোর চোখের পানি প্রমাণ করলো
তুইও আমার বোনকে পছন্দ করতি। যাক, এগুলো মনে রাখিস
না। চল পুকুরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসি। তোকে খুব বাজে লাগছে দেখতে। ছেলেরা কাঁদে না
কি? আমি কোন কথা বলতে পারিনি। তার পিছনে পিছনে হেঁটে পুকুর ঘাটে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে
বন্ধুকে বললাম,
-আমি বাড়ী যাই পড়তে হবে, আজ সারাদিন কোন লেখাপড়া হয়নি।”
সে আমার হাত ধরে বললো,
-তুই এখন যাসনে, আমার বোনটা
তুলকালাম করে ফেলবে। পুরা বিয়ের আয়োজন বরবাদ হয়ে যাবে।
আমি বললাম,
-এমন কিছু হবে না, তোর বোন আমার
প্রেম চেয়েছে এবং আদায় করে নিয়েছে আমার চেখের পানিতে। সে জিতেছে, আমি হেরেছি।
সে রাতে আকাশের পানে তাকিয়ে যে কতটা চোখের জল ফেলেছি। কত লম্বা সময় ধরে বসেছি রাস্তার ধারে তা মনে নেই। প্রচন্ড ঠান্ডায় যখন আর নড়ার শক্তি ছিলো না তখন বাসায় ফিরেছি অনেক গভীর রাতে অনেক গভীর ক্ষত নিয়ে। ভালোবাসা বুঝি এমনও হয়? প্রেম বুঝি এভাবেই জীবনে জড়িয়ে থাকে?
No comments
মন্তব্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।