লেখক-কবি ইন্টারভিউ চ্যালেঞ্জ -১৫
আমাদের অতিথি কবি আমিনুল ইসলাম সেলিম
আট প্রশ্নের মুখোমুখি

আমিনুল ইসলাম সেলিম মূলত কবি হলেও তার রয়েছে বহুমাত্রিক পরিচয়। তিনি একাধারে কবি ছড়াকার গল্পকার নাট্যকার সংগঠক এবং শিক্ষক। ষোড়শ শতকের সাংস্কৃতিক রাজধানীখ্যাত কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চল বলে পরিচিত মিঠামইনের এক নিভৃত পল্লীগ্রাম ছিলিমপুর। সেখানেই সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে পিতা ফজর আলী এবং মাতা আয়েশা খাতুনের সন্তান তিনি। দাপ্তরিক জন্মতারিখ লেখা হয়েছে ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩ সাল। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন আনন্দমোহন কলেজ থেকে।

পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন শিক্ষকতাকে। লেখালেখির শুরু মূলত মাধ্যমিকে পড়াকালেই। সে সময় বিভিন্ন জাতীয় দিবসে দু চার পঙক্তি করে রঙিন কাগজে লিখে সেগুলোই সেঁটে দিতেন স্কুলের দেয়ালে। হাতের লেখা ভালো ছিলো বলে সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতো ছাত্র-শিক্ষকদের। সেসব হয়ে উঠতো একক দেয়ালিকা। তবে পত্রিকায় তার প্রথম লেখা ছাপা হয় ১৯৯৯ সালে, স্থানীয় দৈনিক আজকের দেশ পত্রিকায়। মূলত তখন থেকেই লেখালেখি নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু। তারপর বিভিন্ন কারণে লেখালেখিতে বিরতি এলেও লেখার চিন্তা থেকে সরে আসার কথা ভাবেননি কখনো।লেখালেখিতে নিজেকে আলাদাভাবে চেনাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। বিশেষ করে কবিতায় তার শব্দ নির্বাচন, ছন্দসৌকর্য, ব্যতিক্রম উপমা-উৎপ্রেক্ষার চিন্তাশীল প্রয়োগ, বিষয়গত গভীরতা, ভাব ও ভাবনার পরিস্ফুটতা তাকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল করে তোলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট।

কবিতায় তিনি মানুষের নানামাত্রিক আনন্দ ও দুঃখবোধের পাশাপাশি এঁকে চলেছেন মানবিকতা ও দেশপ্রেমের নির্মল চিত্র। সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তিনি নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। লিখছেন স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক, ছোটকাগজসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে।প্রকাশিত বই পাঁচটি। বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনা করেছেন ছোটকাগজ 'তরঙ্গ' 'একুশ' 'বিজয়' 'চৌপদী' 'সন্দীপন' ইত্যাদি। নিজ জেলার মননশীল সাহিত্য সংগঠন 'সন্দীপন সাহিত্য আড্ডা'র তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন জাতীয় কবিতা পরিষদ, জেলা শাখার। দুর্নীতি বিরোধী সামাজিক আন্দোলন টিআইবির জেলা কমিটিরও সক্রিয় সদস্য তিনি। লেখালেখিই তাঁর ধ্যান, তাঁর সাধনা।

মূলত আমিনুল ইসলাম সেলিমের কবিতা শিল্পময়। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, শব্দচয়ন আর অপূর্ব এক রহস্যময়তার ঘেরাটোপে পাঠককে মন্ত্র্রমুগ্ধের মতো আবিষ্ট করে রাখেন প্রতিটি মুহূর্ত। কবিতায় শুধু নন্দনতত্ব নয়, বরং বিপ্রতীপ এক চিত্রকল্প, জীবনকে ভিন্নভাবে দেখার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস আর চেতনার মৌন সৌন্দর্যে মিশেল এক অনন্য ক্যানভাসে স্বপ্নময়। জীবনের চিত্রকল্প নির্মাণ যেনো তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। কবিতার সেই উদ্ভাসিত পথে যেনো যাত্রা করেছেন আমাদের এই শিল্পের জাদুকর। 

প্রশ্ন ১: আপনার লেখালেখি ও বইয়ের নামসহ সংক্ষিপ্ত আকারে বলুন।
উত্তর: লেখালেখিকে আমি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে নিয়েছি। সে কারণে এটা আমার কাছে উপাসনা। আমি উপাসনা করি জীবনবাস্তবতাকে পুঁজি করে। সে জন্য লিখি মানুষের নানামুখী জীবনের কথা। লিখতে লিখতে, অর্জিত আলো ছড়াতে ছড়াতে আমি হেঁটে যেতে চাই বহুদূর। এমন প্রত্যাশায় জীবনকে আমি উপভোগ করি সৃজনশীলতার নতুন নতুন ভুবন সৃষ্টি করে। লেখালেখিকে জীবন উপভোগ করার এক গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হিসেবে ভাবি।
আমার প্রকাশিত বই ৫ টি
১. চিংফাঁকের দেশ (ছড়া, মুক্তচিন্তা, ২০১০)
২. তখন একাত্তর (নাটক, চন্দ্রাবতী প্রকাশনী, ২০১৪)
৩. গৃহপালিত দুঃখ (কবিতা, বিভাস প্রকাশন, ২০১৫)
৪. জনক তুমি তীর্থভূমি (ছড়া, বিভাস প্রকাশন, ২০১৭)
৫. অদৃশ্য কোলাহল (কবিতা, এবং মানুষ, ২০২০)

২. আপনি যদি না লিখতেন, বাংলাসাহিত্যের কি কোনো ক্ষতি হতো?
উত্তর: প্রশ্নটি সহজ, উত্তর কঠিন। এ প্রশ্নের উত্তরে এক কথায় হয়তো 'না' বলে দেয়া যায়। সাধারণত এমন প্রশ্নে এটা বলেই আত্মরক্ষা করি আমরা। ধরুন, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল যদি না লিখতেন, কিংবা অকালপ্রয়াত সুকান্ত যদি না লিখতেন, তাহলে কী হতো? বাংলাসাহিত্য এতো সমৃদ্ধ হতো না, তাই তো? সাহিত্য একটি সৃজনশীল কর্ম এবং বাংলাসাহিত্য তথা সমগ্র সাহিত্যই একটি সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টার ফল। সে কারণে আমি না লিখলে 'ক্ষতি হতো না' বলা যতো সহজ, তেমনি আমি লিখলে কী উপকার হবে, সেটাও আপেক্ষিক এবং ভবিষ্যৎসাপেক্ষ। সে কারণেই, লিখে বাংলাসাহিত্যের মহাসমুদ্রে সামান্য কয়েক ফোঁটা পানি যদি যুক্ত করে যেতে পারি, সেটাই হবে সার্থকতা।

প্রশ্ন ৩: কখনও কি মনে হয়, লেখালেখি করে খামাখা সময় নষ্ট করছেন?
উত্তর: না। আমার সে রকম মনে হয়নি কখনও। কেননা আমি আসলে সিরিয়াসলি লিখতে এসেছি। লেখালেখিকে কখনও আমি শখ বা বিনোদন ভাবিনি। তাই বিভিন্ন সময়ে হতাশ হলেও লেখালেখি আমার কাছে ফালতু কাজ ছিলো না। বরং মনে হয়, লেখালেখি না করলে হয়তো জীবনটাকেই খামাখা ভাবতাম।

প্রশ্ন ৪: আসলে কেনো লেখেন?
উত্তর: একজন লেখক কেনো লেখেন, বিষয়টা আসলে সহজে বলা যায় না। কিন্তু লেখালেখির তো উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। সেই সার্বিক উদ্দেশ্যের বাইরে লেখকের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য আলাদাভাবে চিহ্নিত করা বেশ কঠিনই। তবু লেখালেখি যেহেতু একটি স্বাধীন শিল্পমাধ্যম এবং এটি লেখকের মনোবৃত্তির পরিচায়ক, সেহেতু লেখকদের উদ্দেশ্যের ভিন্নতা থাকা খুবই স্বাভাবিক। আবার একই শিল্পমাধ্যম হওয়ায় উদ্দেশ্যগুলো অনেকের বেলায় কাছাকাছি বা প্রায় এক রকমও হতে পারে। তবে কারণ হিসেবে দেখলে একটাই কারণ লেখার, আমার লেখার ক্ষমতা আছে এবং আমি না লিখে পারি না। আর লেখার উদ্দেশ্য বিবেচনায় তিনটি বিষয় ভেবে ঠিক করেছি আমি। সেগুলো এই:
১. নিজের ভাবনা, উপলব্ধি, অভিজ্ঞতার সমগ্রতাকে সৃজনশীল রচনায় অন্যদের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যমে মানবজীবনের চিহৃ রেখে যাওয়া।
২. যে কাজটি অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে নিজের কাছে বেশি আনন্দদায়ক, সেটি করে বেঁচে থাকাকে উপভোগ করা।
৩. নিজের কথামালা দ্বারা অন্যদের সামান্যতম হলেও আনন্দ যোগানো, ভাবনা জাগানো এবং উপলব্ধিকে ইতিবাচকভাবে আলোড়িত করা।

প্রশ্ন ৫: লেখালেখির কারণে কোনো সম্মাননা, পুরস্কার, মূল্যায়ণ?
উত্তর: একজন লেখকের জন্য পুরস্কার বা সম্মাননার চেয়ে বেশি উপকারী হলো মূল্যায়ণ। সে মূল্যায়ণ হতে পারে পাঠক কর্তৃক, সমকালীন লেখকগণ কর্তৃক বা প্রাতিষ্ঠানিক। যদি সেটা নির্মোহ হয়, তাহলে লেখকের উপকার হয়, কেননা, সত্যিকার মূল্যায়ণ একজন লেখকের পথ নির্মাণ করে দেয়, লেখকের সত্তার পরিচয়কে উন্মোচিত করে এবং তার ঘাটতি বা চ্যালেঞ্জ বিষয়ে পরিপুষ্ট ধারণা দেয়।
তবে হ্যা, পুরস্কার এবং সম্মাননার যে প্রয়োজন আছে, তা অস্বীকারের দুঃসাহস দেখিয়ে নিজেকে মিথ্যুক প্রমাণ করতে চাই না। সঠিক মূল্যায়ণ এবং পুরস্কার লেখকের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়, তার লেখার আনন্দকে অনেক বেশি সজীব করে তোলে। তার লেখালেখিকে অধিক বেগবান করে। লেখালেখির জন্য আমার প্রাপ্ত একমাত্র পুরস্কার বা মূল্যায়ণ বা সমাননা হলো 'সাহিত্য দিগন্ত কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৮'। আমার প্রথম কবিতাগ্রন্থ 'গৃহপালিত দুঃখ' এর জন্য আমি এ পুরস্কার অর্জন করি।

প্রশ্ন ৬: লেখালেখির জন্য কোনো আবেগপ্রবণ ঘটনার কথা কি মনে পড়ে?
উত্তর: একজন লেখকের জীবনে এ রকম আবেগপ্রবণ ঘটনা হয়তো কম নয়। আমারও না। তবে সবচেয়ে বেশি স্মরণযোগ্য ঘটনা আমার প্রথম বই নিয়ে। প্রথম বই হাতে এলো। তখন ২০১০ সাল। মনে মনে আনন্দে নেচে উঠছি বারবার। বই পেয়ে বাড়িতে ছুটে গেলাম, মার কাছে। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে মার হাতে দিয়ে বললাম, 'মা আমার একটা বই বাইর হইছে।' পাতা উল্টিয়ে দেখালাম, 'আব্বার নামে দিছি। '(উৎসর্গ করেছি বললাম না) মুহুর্তেই মার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মা বইটা হাতে নিয়ে দৌড়ে উঠোনে চলে গেলেন আর বলতে লাগলেন
-এই তরা কই আছস, দেখ আয়া, আমার পুতের বই বাইরইছে।' এই আনন্দের তুলনা নেই।

প্রশ্ন ৭: কখনও কি মনে হয়েছে, একদিন সত্যি সত্যি লেখা ছেড়ে দেবেন?
উত্তর: লেখালেখিকে আমি জীবনের অক্সিজেন ভাবি। এর কমতি হলে জীবনের ফুসফুসে শ্বাসকষ্টের উৎপাত শুরু হবে। জীবনে লেখালেখির জন্য অনেককিছু ছেড়েছি। কিন্তু কোনোকিছুর জন্যই লেখালেখি ছাড়ার কথা কখনো ভাবতে পারিনি।

প্রশ্ন ৮: নিজের লেখক জীবন নিয়ে সংক্ষেপে মূল্যায়ণ?
উত্তর: নিজের লেখক জীবন নিয়ে নিজেকে মূল্যায়ণ করতে গেলে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি- দু ধরনের সমীকরণই চলে আসে। আসে আনন্দের পাশাপাশি হতাশাও। মূলত এ মূল্যায়ণ হওয়া উচিত লেখালেখির শেষে এসে। কিন্তু কার শেষ কখন, কে জানে? তাই বলি, প্রায় প্রত্যেক লেখকই একজন জীবনসংগ্রামী। তাকে লড়তে হয় নিজের সঙ্গে, কখনো পরিবারের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, প্রতিকুল রাষ্ট্রীয় পরিবেশের সঙ্গে। লেখক-চিন্তকদের জন্য এ দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ এখনো বেশ প্রতিকুলই বলা যায়। সেই পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিকূলতার ভেতর একজন সত্যিকার লেখককে টিকে থাকতে হয় আপস না করে। এটা সহজ নয়। লেখালেখির জন্য আমি পরিশ্রম করি, সাধনা করি। সবসময় একটা মানসিক লড়াইয়ের মধ্যে থাকি। নিজের মননকে সবসময় শুদ্ধ চিন্তার ধারক হিসেবে কল্পনা করি। কিছু ভালো কাজ করেছি, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হয়তো এখনো করতে পারিনি। সেটা করতে চাই।
-ধন্যবাদ কবি
-আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
(সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন, কবি ও ঔপন্যাসিক মোস্তফা সোহেল)

No comments

মন্তব্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

Theme images by duncan1890. Powered by Blogger.