জায়েদ হোসাইন লাকীর কবিতা ।




অমরাবতী গোলাপ

পৌষের এক বিপজ্জনক শীতের মধ্যরাতে
একটি সাদা গোলাপের জন্য উদোম গায়ে
নদীর পাড়ে চার ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম।

তখন আমার প্রেম খুব মারদাঙ্গা ছিলো আর
আমি অনেক গাধা ছিলাম।

আমি জানতাম না যে, শীতের মধ্যরাতে
মাথায় প্রেম আর ইন্দ্রিয়ে গোলাপের ঘ্রাণ ঢুকলে
যৌবন থেকে ছিটকে পড়ে আম্রপালী নারী

 
 
তোমার দুটি চোখ যারা ভেবেছিলো আমার

শহর ছেড়ে একদিন গ্রামের জেলে জীবন বেছে নেবো
সেটাই বরং ভালো।
জলে আর ডাঙ্গায় নিসর্গের প্রগাঢ় চুম্বনে
কাটবে আমার উচ্ছিষ্ট জীবন।

তুমি শহর থেকে জীপে করে বেড়াতে আসবে আমার বাড়িতে
ইতস্তত বসবে আমার নিকনো উঠোনে। 
তোমার গায়ের ঘ্রাণে উদ্বেলিত হলেও,
স্মৃতিকে আমি ফিরে যেতে দেবো না পুরনো সেই শহুরে জীবনে।
তুমি অভিমানে স্তব্ধ হয়ে গেলেও, শেষ বয়সে এসে
আর কতটুকুই বা কষ্ট পাবে?

সারা শরীরে জল-কাদা, শালুকের ঘ্রাণ মেখে; সন্ধ্যায়
তোমার জন্য একগাদা মাছ নিয়ে আমি বাড়ি ফিরবো
মাছেদের চোখে চোখ রেখে খুশিতে তোমার চোখ
তখন বিড়ালের মতো জ্বল জ্বলে হয়ে উঠবে।  
মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে আমি তোমাকে রয়না মাছের
ঝোল দিয়ে রাতে ভাত খাওয়াবো

অতঃপর, সকালে তোমার চলে যাওয়ার সময়
আমার জীর্ণ বাড়ির চৌকাঠে
শহরফেরত আরেকটি পাখিকে কাদা-মাটি, গ্রাম আর
নদীর ঘোলা জলে একা ফেলে যাবে ভেবে
হয়তো তুমি খুব কাঁদবে।

তোমার দুটি চোখ শহরের যারা ভেবেছিলো আমার
আমি সেই চোখের কসম দিয়ে বলছি-
সবকিছু ছেড়ে একদিন ঠিকই জেলে জীবন বেছে নেবো। 
  

 
কফিনে বন্দী গোলাপ ও প্রেম

আজ সারারাত বারান্দায় বসে থাকবো
আমার সাথে রাত জাগবে দুটি রেশমের পোকা
কাল সকালে তুমি যখন 'শুভ সকাল' জানাবে
তখন আমি গভীর ঘুমে কোমায় চলে যাব

আমার কোমায় যাওয়ার খবরটি প্রকাশিত হবে
দৈনিক নারকেল পাতায় 

টিভির স্ক্রলে আমার নিহত হবার খবর দেখে
তুমি আঁতকে উঠবে না
একটি সাদা গোলাপ দিতে চেয়েও দিতে পারোনি বলে
তুমি আক্ষেপও করবে না

কোমায় যাওয়া মানুষেরও কোনো আক্ষেপ থাকে না
থাকে না সাদা গোলাপের লোভ
তবুও, আক্ষেপ করে করে আমি যদি কোমায় চলে যাই
এই যে যাওয়া আসা, ভালোবাসা, এসব নির্মম নয়-
এটা প্রেম।

এই নির্মম প্রেমের সাক্ষী হয়ে আছে আমার ব্যাচেলর ব্যালকনি
আর তোমার বাগানে ফুটে থাকা একটি সাদা গোলাপ


 
ক্রসফায়ারে আপত্তি নেই

আমাদের সম্পর্ক আপাতত অমিমাংশিত থাক
ক্রসফায়ারের শেষ দিনে মেতে উঠবো দুজন
আদিম সম্ভোগে পদ্মাসন মুদ্রায়।

একে একে খুলে ফেলবো শরীরের সব করটি,
অস্থি মজ্জা আর মাংসের কিমা
তখন দুজন শুধু দুজনের হবো
অতঃপর মিলিত হবো শেষ চুম্বনে
লোকে দেখে বলবে সবাই,
-ছিঃ ছিঃ তোদের এ কী পাপ! 

আমরা তখনো শুধু একে অন্যকে ভালবাসতেই থাকবো
তারপর আমাদের ক্রস ফায়ার হয়ে য্কা
আপত্তি নেই।


 
মানুষ হতে গেলে মধ্যবয়স লাগে

এক সময় মনে অনেক প্রেম ছিলো
ছিলো আবেগ আর অভিমান
উড়তে উড়তে ফেরারী কোনো ফড়িং 
যদি ডানা ভেঙে যেত তাহলে, তা দেখে
আমি খুব কাঁদতাম।

কতবার যে কাচারি ঘরের পাটাতনে উঠে
লুকিয়ে  ফুপিয়ে কেঁদেছি,
বাবা যখন অযথাই মাকে বকতেন।

আমার এ সব বাচ্চামি দেখে প্রতিবেশীরা
হাসাহাসি করে বলতেন,
-ছেলেটা কবে মানুষ হবে?
সম্ভবত তখন আমি অমানুষ ছিলাম।

আজ মধ্য বয়সে এসে জীবনের মধু
নিজের সঙ্গে পান করতে যেয়ে দেখেছি,
আমার মনে কোনো প্রেম নেই।
আবেগ, অভিমান আর প্রবল অনুভূতিগুলো
এখন আর আমার ভেতরে বিন্দুমাত্র নেই।

আমি ক্রমশ অমানুষ থেকে মানুষ হযয়ে উঠছি।
নিজেকে মানুষ ভেবে আমি এক বিস্ময়কর সুখ
অনুভব করতে শুরু করেছি
এ জন্য, বনানী বা কুমিল্লায় নয়তা কোলকাতায়
কেউ ধর্ষিত হলে বা কাঁটাতারে ফেলানির লাশ পড়ে
থাকলে নয়তা চোখের সামনে কাউকে খুন হতে দেখলে
এখন আর আমার মন একদমই কাঁদে না।

কোনো যাযাবর ফড়িং এর ডানা এখন আমি দুহাতে
টেনে হিঁচড়ে ছিড়ে  ফেলতেও পারি।

যারা আমাকে অপমান, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা আর
দুঃখ কষ্ট দিযয়েছিল যৌবনের প্রথম ভাগে
আমি মানুষ হতে শিখেছি বলেই আজ 
তাদের আমি ক্ষমা করে দিলাম।

বিশ্বাস করো,
জাহেলিয়াত যুগ শুরু হলেও তাতে আমার
কিছুই এসে যায় না।

চেতনার মুখে আমি আজ কুলুপ এঁটে দিযয়েছি।
তুমি আমার এ ক্রমান্নতি দেখে দুহাতে
তালিয়া বাজাতে পারো!



 
আমি আবার একদিন বেল তলায় যেতে চাই

চুল ছোট করার পরে দেখলাম
আমার মাথার উপরে ঘুঘুর ডিমের মতো
সুন্দর একটি টাক পড়ছে।

এই মাথার সবটা জুড়ে একদিন টাক পড়বে
পুরো মাথাটা তখন কবুতরের
চোখের মতো চকচকে দেখাবে।

তুমি আমাকে প্রায়ই বলতে,
-কবি তোমার মাথায় কিছুই নাই।
সে কথাটি একদিন সত্যি হবে।

আমার মাথায় টাক পড়ার পরে
তুমি আর আমি একদিন বেল তলায় যাব।
তখন আমার চকচকে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে
তুমি বলবে,
-কবি তোমার মাথায় সত্যিই কিছু নাই!
তখনও আমি তোমার কথা মাথা পেতে মেনে নিব

আসলে, তুমি ছাড়া আমার মাথায়
আর কেউ নেই, কিছু নেই।



 
তাকে মনে করতে না পেরে একদিন আমি ঠিক মরে যাব

দীর্ঘ জীবন যাকে ভালোবেসেছি
আজ তার ছায়া মনে নেই!

তার একটি চুম্বনের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে
আমি কী  খুব ক্লান্ত হতাম?
তার বুকের দ্রাঘিমা আমি কখনো মেপে দেখেছি?

রিক্সার ব্রেক চাপলে-
সে রাস্তায় ছিটকে পরে যেতে পারে,
এই ভয়ে আমি কখনো তার হাত চেপে ধরেছিলাম?

আমার আক্সগুলের স্তম্ভগুলো হিংস্র সাপ হয়ে নেচে নেচে
কখনো কি তার গোপন সৌরভ ¯পর্শ করেছিলো?
অথবা, আমার বাম গালে ঠাস করে চড় মেরে
কখনো কি সে বলেছিলো-
–তোমার চোখে প্রেম না, পাপ নাচে ক্যান?

কী নাম ছিলো তার?
রাজশ্রী?
আরতী? 
অরুন্ধতী?
নয়তো, 
ইসাবেলা খান?
নাকি তার কোনো নামই ছিলো না?

মনে নেই! মনে নেই! মনে নেই!
আমার এসবের কিছুই মনে নেই মাননীয় আদালত। 

তার কামরাঙা ঠোঁটের মাঝেখানে
খুব গাঢ় আর কালো একটি তিল ছিলো,
শুধু এটুকু মনে আছে।



 
কোনো কোনো রাতে আমি খুনি হয়ে উঠি

আজ সারারাত লোডশেডিং হোক
ছাদে বসে জোছনা মাখবো গায়ে
নিকোটিন নয়, আজ রাতে পান করবো
অকুণ্ঠ জোছনার শরাব

শার্টের বোতামে অনেক জোছনাপোকা বসে আছে
মনের ভেতরে আছে একটি নিঃসঙ্গ ক্ষুধার্ত বাঘ
নৈঃশব্দের সম্মোহনে আমি ক্রমশ হয়ে উঠেছি যেন
ট্রয়ের করুণ ইতিহাস

শহরের সবগুলো ছাদে আজ অমোঘ পূর্ণিমা রাতে
আততায়ী চাঁদের দূরন্ত উন্মাদনা
লিউনার বারান্দায় একটি  অচেনা ভ্রমর ওড়ে
পৃথিবীর সব ছাদ-বারান্দা আজ রাতে শুধুই আমার

জোছনার মৈথুনে উড়ে যায় ঘাম ঝরা বিগলিত মন
খুনী জোছনা আমাকে ভেঙ্গেচুরে একেবারে টুকরো টুকরো করে

এমন উন্মাতাল জোছনা রাতে
ছাদে এলে তুমি খুন হয়ে যেতে পারো


 
ভূমিবালিকা

পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে এক অমৃতনদী
তার পাশে এক স্বর্গশহর, নাম রোয়াংছড়ি
ওখানে এক আদিবাসী প্রিয়তমা আমার জন্য
সূর্যমুখীর গাছ লাগিয়েছে তার বাড়ির উঠোনে

আমি তার জন্য শহর থেকে কিছু রোদ্দুর
আর রেশমের উষ্ণতা সাথে করে নিয়ে যাব।
পাহাড়ের চড়ায় দাঁড়িয়ে আমারা দুজন হাত ধরাধরি করে
আকাশকে রোদ্দুর আর পাহাড়কে উষ্ণতা উপহার দিব

তুমি কী আমাকে ভালোবেসে ফতুর করে দিতে পারবে
-আন্দ্রে মারিয়া?



 
কান্নার বায়োগ্রাফি

মাঝে মাঝে আমি খুব প্রাণ খুলে কাঁদি,
এটা কী কোনো রোগ?
নাকি ঝড়ে ভেঙে নুইয়ে পড়ার পূর্বাভাস?

যেদিন তুমি বলেছিলে,
-আর কখনো তোমার মুখ দেখবো না
সেদিন আমি খুব হেসেছিলাম, তুমিও।

তুমি এত সুন্দর করে হাসতে হাসতে
সত্যগুলো বলো কী করে?
তোমার সে কথাগুলো আজ সত্যি হয়েছে ভেবে
এখন আমি খুব কাঁদি।

আচ্ছা, তুমি কী আমার কান্না দেখে
দূর থেকে হাসো, আগে যেভাবে হাসতে?
এতসব তুমি পারো কি করে?

অথচ, কান্না ছাড়া এ জীবনে আমি
আর কিছুই করতে শিখিনি


 
 ১২ জুন ২০২০, ঢাকা।

2 comments:

  1. কবিতা পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ ।

    ReplyDelete
  2. অনেক সুন্দর হয়েছে।

    ReplyDelete

মন্তব্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

Theme images by duncan1890. Powered by Blogger.