অনুবাদ সাহিত্য সাহিত্যের অনুবাদ



জায়েদ হোসাইন লাকী : জাক্স্ ডেরিডা, ওয়াল্টার বেনাজামিনের একটি বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেছিলেন, অনুবাদ কোনো গ্রন্থ বা মুদ্রিত পাঠ্যবস্তুর টিকে থাকা নিশ্চিত করে। তিনি এ-ও বলেছেন, অনুবাদ আসলে সাহিত্যকর্মের অন্যজীবন দেয়, আর এক নতুন মৌলিক অস্তিত্ব সৃষ্টি করে অপরাপর ভাষায়। প্রসঙ্গত জোসেফিন পামার এ-ও বলেছেন, - অনুবাদ ছাড়া কি আমরা পড়তে পারতাম খ্রিস্টপূর্ব সাত দশকের গ্রিক মহিলা কবি স্যাফোর কবিতা বা পাঁচ দশকের গ্রিক নাট্যকার ইসকিলাসের নাটক?


অনুবাদকর্মের আলোচনায় সনাতনভাবে দুটি বিতর্কিত বিষয় উত্থাপিত হয়- আনুগত্য ও স্বাধীনতা (fidelity and license)। অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্য ভাষান্তরের স্বাধীনতা এবং তা করতে যেয়ে মূলের প্রতি অনুগত থাকা। মানতেই হবে, অনুগত থাকার অর্থ এই নয়, উৎস ভাষার অর্থটিকেই বিশ্বস্তরূপে অনুকরণ করা আক্ষরিকভাবে। কারণ শব্দ বা word কখনই কোনো সাহিত্যকর্মের অন্তর্নিহিত অর্থকে চিহ্নিত করে না। কারণ যে কোনো শব্দের দুটি অবস্থান রয়েছে- বিশেষ করে সাহিত্যকর্মে- একটি আভিধানিক এবং অন্যটি দ্যোতনিক বা গূঢ়ার্থিক। বিরোধ বাধে ওই দ্যোতনিক বা গূঢ়ার্থিক শব্দের ভাষান্তরকালে। যদিও নীতিগতভাবে অনুপযোগী (politically inappropriate) তবুও বর্তমান প্রসঙ্গে উপযোগী, আমি এই উদ্ধৃতিটি বিনয়ের সঙ্গে উত্থাপন করতে চাই : Translation is like a woman: if she is faithful, she is not beautiful; if she is beautiful, she is not faithful. গূঢ়ার্থটি হল, অনুবাদক কখনই একাধারে মূলের সঙ্গে অনুগত থেকে নান্দনিক অনুবাদকর্ম করতে পারে না। নান্দনিক বা সুন্দর হতে হলে স্বাধীনতা অপরিহার্য।


ড. খালিকুজ্জামান তার এক প্রবন্ধে বলেছেন : ‘অনুবাদ আসলে মর্যাদাসম্পন্ন সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি পেতে শুরু করে গত শতাব্দীর ৮০-র দশক থেকে। যথার্থভাবে অনুবাদ কোনো শিল্পকর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ৯০-এর দশকের পর। যতদূর মনে পড়ে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই- অর্থাৎ ১৯৫৫ থেকেই অনুবাদের একটি বিশিষ্ট স্থান নির্ধারিত ছিল, যার জন্য তার নিঃশর্ত প্রশংসা অবশ্য প্রাপ্য যদিও এই প্রতিষ্ঠান থেকে সুপ্রচুর অনুবাদকর্ম প্রকাশিত হয়েছে বলে দাবি করা যাবে না।’ শিল্পের অনুকরণপ্রবণতায় অনুবাদের একটি সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে- উপর্যুক্ত প্রবন্ধে খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের এই মন্তব্যও সমর্থনযোগ্য। এই প্রসঙ্গে আমি ২০১০ সালে লেখা এবং Words Without Borders পত্রিকায় প্রকাশিত Edith Grossman-এর একটি উক্তির শব্দান্তরিত উদ্ধৃতি তুলে ধরতে চাই। Grossman বলছেন প্রায় সব অনুবাদকই একান্তে নিজেদের মৌলিক লেখক রূপেই বিচার করতে চায়, কারণ অনুবাদকরা যখন এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় পুনর্লিখন করেন তখন তারা মূল ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মের অন্তর্নিহিত আবেগানুভূতি, শৈল্পিকতা ও নান্দনিকতাকে সম্যক উপলব্ধি করে অনূদিত ভাষায় পুনঃস্থাপন করার চেষ্টা করেন, যেটিকে সব সফল অনুবাদকের সর্বোচ্চ ও তীব্র যাচনা বলে চিহ্নিত করা যায়- আর সে অর্থে সব ভালো ও সফল অনুবাদকই লেখক।

কিন্তু এই ভালো অনুবাদক কারা? সম্ভবত তারা যারা মূল ও অনূদিত উভয় ভাষাতেই রচনাশৈলীর তীক্ষ্ণ অনুভূতিসমূহকে ধারণ করতে সক্ষম। বিষয়টি অবশ্যই আপেক্ষিক; কারণ এ ব্যাপারে অনেক বিদগ্ধজনই আরও অনেক অনেক ভিন্ন ভিন্ন শর্ত আরোপ করতে পারেন- তবে রচনাশৈলীর নান্দনিকতা অবশ্যই এ পর্যায়ের একটি পূর্বশর্ত।

ড. ইলিয়াস প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, শিল্পকর্মের জন্ম হয় অন্য শিল্পের অনুকরণে এবং অনুপ্রেরণায়’। এ বিষয়ে কিছু উদাহরণ হাতের কাছেই রয়েছে- ইংরেজিতে অনূদিত হোমারের মহাকাব্য পাঠ করেই মাইকেল মেঘনাদবধ কাব্য রচনায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন। সেরভেনতেসের ডন কিহটির অনুবাদ পড়ে ইংরেজি উপন্যাসে হেনরি ফিল্ডিং এবং ফক্নার সেরভেনতিস রচনাশৈলীর প্রবর্তন করেছেন। ঠিক তেমনিভাবে ফক্নারের হিস্পানিতে অনূদিত উপন্যাস পড়ে গার্সিয়া মারকেস প্রভাবিত হয়েছেন। বলা হয় তার One Hundred Years of Solitude-এ (যাকে চিহ্নিত করা হয় গত পঞ্চাশ বছরে রচিত বিশ্বসাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ও উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের) ফক্নারের প্রভাব রয়েছে।

বিশ্বসাহিত্যে শার্ল বোদলেয়ারের ফ্লরস্ ডু মলের প্রভাব আধুনিক কবিতার ওপর কিংবা হোর্হে লুইস বোর্হেসের প্রবন্ধ রচনাশৈলীর প্রভাব আধুনিক প্রবন্ধ রচনায় মূলত তাদের সাহিত্যকর্মের ইংরেজি ও অপরাপর ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমেই। বাংলা কবিতায় এডগার অ্যালান পো এবং বোদলেয়ারের প্রভাব জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় অত্যন্ত ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে স্পষ্ট।
অনুবাদের অন্তর্নিহিত শক্তির উদাহরণ আরও অনেক আছে। ফলে এ কথা সহজেই সমর্থন করা যায় : Translation affects creative artists in another…………, The impact of the kind of artistic discovery that translation enables is profoundly important to the health and vitality of any language and any literature. (Grossman, 2010).
আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, অনুবাদ শুধু মূলকে স্থানচ্যুতই করে না অনেক সময়ই কালচ্যুত ও সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিচ্যুতও করে। ঠিক এ কারণেই অনুবাদকের কাজ জটিলতর হয়ে ওঠে। মানতেই হবে সময় ও ভাষার প্রবাহমানতা অনুবাদকর্মকে অবশ্যই প্রভাবিত করে অথচ অনুবাদককে সর্বদাই মূল পাঠের রচনাশৈলী ও বৈশিষ্ট্যগুলো গ্রাহ্যে এনেই অনুবাদকর্ম সম্পন্ন করতে হয়।
প্রসঙ্গত অনুবাদ বিষয়ে ডেরিডার আরও একটি উক্তি স্মরণে আসে। তিনি বলেছেন- একই সাহিত্যকর্মের একই ভাষায় একাধিক অনুবাদ হওয়া বিশেষ প্রয়োজন প্রধানত সময় ও ভাষার সচলতার সঙ্গে সাযুজ্য রাখার জন্য। আমরা তো জানি জন কীট্স্ সেই সনেটটি লিখেছিলেন-On First Looking Into Chapman's Homer-Chapman অনূদিত হোমার পড়ে বিমোহিত হয়ে। Chapman-এর হোমারের (১৮৫৭) পর কয়েক শতাব্দী পার করে ’৬০-এর দশকে আমি ছাত্র থাকা কালে E.V. Rieu-এর Odyssey অনুবাদকে (১৯৪৬) পাঠ্য হিসেবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে তার সহজবোধ্য ভাষা, উপমা ও উৎপ্রেক্ষার সরল ভাষান্তরের কারণে। আমরা তো জানি ইংরেজি ভাষায় হোমারের আরও অনেক অনুবাদ হয়েছে। একই সাহিত্যকর্মের একাধিক অনুবাদের আরও একটি উদাহরণ মনে পড়ছে TS Eliot-এর The Journey of the Magi-এর বাংলা ভাষান্তর। রবীন্দ্রনাথ ও সম্ভবত বিষ্ণু দে’র অনুবাদ। সম্ভবত বলছি কারণ স্মৃতিতে এটি অবশ্যই স্পষ্ট কবিতাটির একাধিক অনুবাদ আমি পড়েছি; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্যান্য অনুবাদকের নাম স্মরণে তেমন জাগ্রত নয়। এর একটি কারণ আবার সম্ভবত আমার একান্ত বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথের অনুবাদই শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে। ঠিক এই বিচারেই অনুবাদকর্ম যে কোনো মৌলিক সাহিত্যকর্মের সঙ্গে তুল্য- যেমন সব সাহিত্যকর্ম মনে স্থায়ী হয় না তেমনি সব অনুবাদকর্ম মনে দাগ কাটে না। এ পর্যায়ে গায়ত্রী চ্যাটার্জি স্পিভাকের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হতে পারে। তিনি The Politics of Translation-এ বলছেন : ‘Language is not everything. It is only a vital clue to where the self loses its boundaries.’ মহাশ্বেতা দেবীর ‘স্তন্যদায়িনী’ উপন্যাসের নামকরণের অনুবাদ বিষয়ে গায়ত্রী উদাহরণ দিচ্ছেন, এক অনুবাদক উপন্যাসের শিরোনামের ভাষান্তর করেছেন ‘Breast-giver’, অন্য একজন করেছেন ‘The Wet-nurse.’ দুটি অনুবাদকে পাশাপাশি রাখলে স্পষ্ট হবে মূলে যে ভাষিক অলঙ্করণ অন্তরালে ছিল তা দু’ভাবে এ দুটি ভাষান্তরে উচ্চকণ্ঠ হয়েছে কারণ উপন্যাসের অনূদিত শিরোনাম পার্থক্যই অনুবাদকদের মূলত অনুবাদকর্মে পরিচালিত করেছে। মূল উপন্যাসে যদিও মার্কস এবং ফ্রয়েডিও তত্ত্বের আভাস পাওয়া যায়, আসল রহস্যটি অন্তর্নিহিত আছে পাঠক এবং অনুবাদকের আপন-আপন উপলব্ধি ও ব্যাখ্যার ওপর। এমনটা হওয়াই অনিবার্য। শেক্সপিয়রও অবিরাম অনুবাদ হচ্ছে বাংলাতে তার উদাহরণ সবারই জানা।
অনুবাদের ব্যাপারে অনেক রক্ষণশীল পাঠকই ‘lost in the translation’ বিষয়ের বিতর্কটি উপস্থাপন করেন। অনুবাদে মূলের বিনষ্টিকে মেনে নিলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি একজন সফল অনুবাদক- আমার পূর্বোক্ত বক্তব্যের জের ধরে বলতে চাই- তিনিই, যিনি মৌলিকভাবে লেখক। একজন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার বা প্রাবন্ধিক মৌলিক সাহিত্য রচনার মাধ্যমে তার বিভিন্ন পাঠককে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোড়িত করেন, ঠিক তেমনি একজন সফল অনুবাদক তার অনুবাদকর্ম দিয়ে, তা সাহিত্যের যে শাখাতেই হোক, সমপর্যায়ে তার পাঠকদের আলোড়িত করতে সক্ষম।


প্রতিটিরই একটি নিজস্ব প্রকাশশৈলী আছে। যেমন নাটক- যেখানে semiotics বা লিখিত ভাষায় ব্যবহৃত প্রতীক ও সাংকেতিক চিহ্নসংক্রান্তের প্রতিফলন ঘটে- মিখাইল বাখ্তিন যাকে বলেছেন কার্নিভালেক্স। বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীভেদ, পদমর্যাদা, শিক্ষা, চরিত্র, মেধা এবং আবেগ সংলাপের মাধ্যমে উপন্যাস ও নাটককে উদ্ঘাটিত হতে হয়। বলা যায় সাহিত্যের সব শাখাতেই বিষয়টির উপস্থিতি স্পষ্ট। একজন অনুবাদককে এসব বিষয়াদি মনে রেখেই ভাষান্তরে নিয়োজিত হতে হয়। এ কথাও সত্যি এক ভাষার semiotics অন্য ভাষার মানুষদের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। যদিও বলা হয়ে থাকে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের বৈদ্যুতিক যোগাযোগ বা তথ্যপ্রযুক্তি মাধ্যমের অভাবনীয় বিস্ফোরণের কারণে সারা বিশ্বের মানুষ পরস্পরের অনেক কাছাকাছি এসে গেছে- তবুও মানুষের জীবনযাপনের সদাপরিবর্তমান ধারা অনুবাদকর্মকে সহজ করেছে বলে মনে হয় না। ফলে এ কথা সত্য হয়ে আছে যে কোনো অনুবাদকর্মই সুন্দর হবে না যদি অনুবাদক শুধু মূলের সঙ্গে সাযুজ্য রাখার চেষ্টাতেই তার অনুবাদকর্মকে সীমাবদ্ধ রাখে। অনুবাদককে সচেতনভাবেই অনেক স্বাধীনতা নিতে হয়- তবে অবশ্যই Sir Richard Burton-এর Arabian Nights-এর মতো স্বাধীনতা কোনোক্রমেই নয়। ভাষা বিজ্ঞানীরা বলেন, ভাষাই সংস্কৃতি। ফলে অনুবাদককে সর্বদাই উৎস-ভাষা (SL) থেকে লক্ষ্য ভাষায় (TL) স্থানান্তর করার সময় দুই ভাষারই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরম্পরা অনুধাবন করেই অনুবাদ করতে হয়। ঝরৎ Richard Burton এ কাজটি তেমনভাবে করেননি বলেই আরব্য উপন্যাস অনুবাদের মতো প্রশংসনীয় কাজটি করেও অনুবাদ জগতে নিন্দিত হয়েছেন এ কারণে যে তিনি আরবি ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিবেচনা করেছেন ‘other culture’ বা নিুমানের সংস্কৃতি রূপে, ফলে ইংরেজ পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন এক যৌন আবেদনময়ী অনুবাদ কর্ম। ব্যাপারটি ঘটেছে মূলত উৎস-ভাষাকে লক্ষ্য ভাষা থেকে নিকৃষ্ট মনে করার কারণেই। Edward Fitgerald সম্বন্ধেও এমন অভিযোগ পাওয়া যায়।
সাহিত্যের অনুবাদ (গদ্যানুবাদ)
সাধারণভাবে সাহিত্যের অনুবাদে একাধিক বিবেচনার বিষয় বর্তমান যার কিছু কিছু পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে যে ক’টি উপাদান আরও একটু ব্যাখ্যা করতে চাই সেগুলো হল- ইউজিন নিডা’র বলা : ক. সাহিত্যকর্মে বিদ্ধৃত বাণীর প্রকৃতি খ. সাহিত্যকর্মের অভীষ্ট লক্ষ্য এবং গ. অনূদিত ভাষার পাঠকদের গ্রহণ ও অনুধাবন ক্ষমতা- এই ত্রিবিধ বিষয় বিশেষভাবে বিবেচ্য।
ক. বাণীর সঙ্গে সাহিত্যকর্মের বিষয়বস্তু ও কাঠামোর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। মানতেই হবে বিষয়বস্তু ও কাঠামোকে ব্যবচ্ছেদ করা যায় না। কিন্তু অনেক সাহিত্যকর্মেই দেখা যায় বিষয়বস্তু প্রধান আবার অন্য অনেক সাহিত্যকর্মে কাঠামোই মুখ্য। এক ভাষার বিষয়বস্তু বা কাঠামো ভাষান্তরে মূল্যহীন বা তাৎপর্যহীন হয়ে যেতে পারে। যেমন বের্টল্ট ব্রেখ্টের Mother Courage-এ দেখা যায় এক মা তার সব ছেলেমেয়েকে হারিয়েও বাঁচতে চায়। এমন মা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় তেমন তাৎপর্যপূর্ণ নয় বরং নিন্দনীয়। সেখানে অনুবাদককে যথেষ্ট নান্দনিক শ্রম দিতে হয় মূল বাণীটিকে স্পষ্ট করার জন্য।
খ. সাহিত্যকর্মের অভীষ্ট লক্ষ্য কী তার ওপর অনুবাদকর্মের চারিত্র্য নির্ভরশীল অনিবার্যভাবে। এ ব্যাপারে অনুবাদক ও মূল লেখকের অভীষ্ট লক্ষ্য সমান্তরাল হওয়াই একান্ত কাম্য- অন্যথায় শিল্পকর্মের ভুল ব্যাখ্যা হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। ফলে একজন অনুবাদককে প্রতিটি অনুবাদ কর্মের জন্য অতিরিক্ত অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে হয় : ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাময়িক ও স্থানিক, সাংস্কৃতিক এবং এমন আরও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি। যারা অনুবাদকর্মে লিপ্ত আছেন তারা এ কাজগুলো নিয়মিত করে থাকেন।
প্রসঙ্গত গত শতাব্দীর বিখ্যাত রুশ ভাষাবিদ ও semiotics বিশেষজ্ঞ মিখাইল বাখ্তিনের হেটেরোলজি বা বহুমুখিতা তত্ত্বের অবতারণা আবার করতে চাই। বাখতিন সমাজের বহুমুখিতার দুটি অবস্থান চিহ্নিত করেছেন- হেটেরোগ্লসিয়া বা ভাষিক বহুমুখিতা এবং হেটেরোফোনি বা বক্তব্যের বহুমুখিতা। ভাষা ও বক্তব্যের বহুমুখিতা প্রতিটি জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিকতার শ্রেণী-বিন্যাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে বাংলাদেশের নারীবাদীদের ভাষা ও বক্তব্য ইউরোপের নারীবাদীদের থেকে ভিন্নতর যেমন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রায় কোনো মিল নেই। ফলে সাহিত্যে, বিশেষ করে ফিকশনে- অর্থাৎ গল্প, উপন্যাস, নাটকে- অনুবাদের সময় অনুবাদককে উৎস ভাষার ভাষাগত ও বক্তব্যগত বিষয়াদি এবং ওই জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন, মেলামেশা, চালচলন, আচার-আচরণ, পোশাক ইত্যাদিসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত বিষয়াদি সম্বন্ধে পর্যাপ্ত পড়াশোনা করতে হয়। বাখ্তিন বলেন, একটি নাটক বা উপন্যাসে যত চরিত্রের উপস্থিতি তা কোনো কার্নিভ্যালে জড়ো হওয়া জনগোষ্ঠীর মতো। ফলে প্রতিটি মানবচরিত্রের বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটে নাটকে বা উপন্যাসে। সেগুলো সঠিক উপলব্ধি করে অনুবাদকের অনুবাদ কর্মে লিপ্ত হতে হয় আর তা না হলে অনুবাদে চরিত্রগুলো সমতল বা flat হয়ে যায়। এ ব্যাপারে অনুবাদের অনুবাদ একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।
গ. পাঠকদের গ্রহণ ও অনুধাবন ক্ষমতা বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যে পাঠকরা অনুবাদকর্মটি পাঠ করবেন তাদের অর্থ ও সংকেত উদ্ঘাটন ক্ষমতা কত সূক্ষ্ম এটি অবশ্যই বিবেচ্য বিষয়। প্রবন্ধ অনুবাদে এ বিষয়টিই প্রধান বিবেচ্য হয়ে ওঠে। প্রবন্ধে যে ব্যাপারটি উৎস ভাষায় উপস্থাপিত হচ্ছে তা কতটা লক্ষ্য ভাষার পাঠকদের বোধগম্য বা অনুধাবনযোগ্য সেটি অনুবাদকের বিবেচনায় এনে তার শব্দ ও ভাষা নির্বাচন একান্ত কাম্য।
গল্প বা উপন্যাসেও বিষয়টি বিবেচ্য- বিশেষ করে James Joyce বা Virginia Woolf অনুবাদে stream of consciousness-এর ভাষিক ব্যবহার যেটি বাংলাভাষায় প্রাথমিকভাবে সম্ভবত কমলকুমার মজুমদার এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাদের গল্প-উপন্যাসে ব্যবহারে সচেষ্ট হয়েছেন। বলতেই হবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসই সবচেয়ে সফল এ ব্যাপারে। অনুবাদকের এমন প্রকাশশৈলীর সঙ্গে পরিচয় না থাকলে ভাষান্তর দুর্বোধ্য হতে বাধ্য।
নাটকের ব্যাপারে আমি Mother Courage নিয়ে আগেই বলেছি। এর সঙ্গে রয়েছে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক বিসঙ্গতি। বিভিন্ন পাঠক ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে বিচার করেন।
আমাদের দেশের অনেকেই আছেন যারা ব্রিটিশ বা পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে আফ্রিকি সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ঐতিহ্যকে নিকৃষ্টমানের মনে করেন। ফলে তাদের দেশের গল্প, উপন্যাস, সাহিত্যকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন। আমাদের নৃগোষ্ঠীদের অনেকেই সভ্য মনে করেন না- ফলে তাদের ভাষা ও সাহিত্যকর্ম সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে অনেকেরই একটি নেতিবাচক মনোভাব আছে। বলা হয় আরবি ও ফার্সি থেকে রিচার্ড বার্টন ও ফিটজেরাল্ড যখন ইংরেজিতে যথাক্রমে আরব্য উপন্যাস এবং ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ অনুবাদ করেন তখন তারা এ চিন্তা থেকে অনুবাদকর্মে লিপ্ত হন যে ইংরেজ পাঠকদের ওই দুটি তাৎপর্যহীন ভাষার সাহিত্যকর্ম বিষয়ে অবগত করা এবং ভাষা দুটিকে মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থানে নিয়ে আসা। ফলে দু’জনই অনুবাদকর্মে ইংরেজ পাঠকদের উপযোগী ভাষান্তর করার প্রচেষ্টায় তাদের নিজ নিজ অনুবাদকর্মে মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতা নিয়েছেন। অনুবাদককে এ ব্যাপারে সাবধান হয়ে উদারপন্থী আচরণ করতে হয়।
তবে সাংস্কৃতিক বিসঙ্গতির অন্যরূপও রয়েছে। পশ্চিমা দেশের খোলামেলা ভাষা ও জীবনযাপনও আমার মতো অনুবাদকদের বিপদে ফেলে। যেমন নাটকে গালাগাল ও খিস্তিখেউড় বা প্রকাশ্যে নারী-পুরুষ আলিঙ্গন, দৈহিক স্পর্শ, নৈকট্য ও চুম্বন। আমার নাটক অনুবাদকর্মে একাধিকবার এ সমস্যা হয়েছে- ভাবতে হয়েছে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কথা, দর্শকদের কথা। তবে নাটকের পাঠটি আমি বিশ্বস্তভাবেই অনুবাদ করি- মঞ্চ ভাষ্যটি থাকে নির্দেশকের তত্ত্বাবধানে।

No comments

মন্তব্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

Theme images by duncan1890. Powered by Blogger.